হজ ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদ। আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতা রয়েছে এরূপ মুসলমান নর-নারীর ওপর হজ ফরজ। হজ অত্যন্ত পুণ্যময় ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হজের আনুষ্ঠানিকতার সাথে বায়তুল্লাহ, হাজরে আসওয়াদ, সাফা-মারওয়া, মিনা-আরাফা- মুজদালিফা প্রভৃতি পবিত্র স্থানসমূহের নাম বিজড়িত রয়েছে। এসকল পবিত্র স্থানসমূহ দুনয়নে অবলোকনের ব্যাকুলতা মুসলমানদের আজন্ম লালিত অভিলাষ। আর কোন মুসলমান যদি কখনো সৌদি আরবে যান নিমিষের জন্য হলেও তিনি চাইবেন মসজিদে নববী এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) রওজা মোবারক জিয়ারত করে আসতে। পূর্ণ আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে মুমিনদের জন্য হজ পালন চির আরাধ্য। প্রত্যেক মুসলমান তার অন্তরে হজ পালনের তীব্র বাসনা লালন করেন।
হজের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় হৃদয় মোহাবিষ্ট থাকলেও অতি সংগোপনে সেই হৃদয়েই বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে শঙ্কা তৈরি হয়। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অচেনা রাস্তাঘাট, অপরিচিত মানুষ আর অজানা ভাষা! পথ হারানোর ভয় ও যোগাযোগ না করতে পারার বিড়ম্বনা অনেককে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে। অবশ্য কিছুটা ভয় পাওয়া দোষের নয়; বরং এটাই স্বাভাবিক।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি মানুষের যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচে গেছে অনেকটাই। দূরে থেকেও মানুষ এখন সন্নিকটে, হাতের কাছেই। গোটা পৃথিবীটাই এখন হাতের মুঠোয়। হজ ব্যবস্থাপনায়ও প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনীর সন্নিবেশ ঘটেছে। হজের নিবন্ধন, তাঁবু বরাদ্দ, হোটেল ভাড়া ও অন্যান্য সার্ভিস কোম্পানির সাথে চুক্তি, ভিসা প্রক্রিয়াকরণ প্রভৃতিই সম্পন্ন হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে।
এবছর বাংলাদেশ সরকার হজ ব্যবস্থাপনায় যোগ করেছে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল অ্যাপ, হজ প্রি-পেইড কার্ড ও মোবাইল সীম রোমিং সার্ভিস। হজের সফরকে সহজ, মসৃণ, নিরাপদ এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার নিবিড় তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় ‘লাব্বাইক’ শিরোনামের মোবাইল অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এই মোবাইল অ্যাপ হজযাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্মত সেবা প্রদানে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। গুগল প্লে স্টোর থেকে এই অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। এছাড়া, ডাউনলোড লিঙ্ক অথবা কিউআর কোড স্ক্যান করে ডাউনলোড করার সুযোগ রয়েছে। এই অ্যাপে রেজিস্ট্রেশনের সময় হজযাত্রীর মোবাইল নম্বর, পিআইডি (পিলগ্রিম আইডি) ও জন্ম তারিখ প্রয়োজন হবে। ওটিপি যাচাইয়ের পর ৪ ডিজিটের পিন সেট করতে হবে। একজন হাজী তার পরিবারের সর্বোচ্চ ৩ জন সদস্যকে ইনভাইটেশন পাঠিয়ে অ্যাপে যুক্ত করতে পারবে। পরিবারের সদস্যের নাম ও মোবাইল নম্বর দিয়ে ইনভাইটেশন পাঠালে উক্ত সদস্য তার মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার পর তাঁরা হাজীর তথ্য জানতে পারবেন। এছাড়াও গেস্ট ইউজার হিসেবেও রেজিস্ট্রেশন করা যাবে।
`হজযাত্রী হারিয়ে গেলে বা গুরুতর অসুস্থ বা বিপদে পড়লে জরুরি মুহূর্তে এই মোবাইল অ্যাপ থেকে এসওএস (সেভ আওয়ার সোলস) বাটনে ক্লিক করলে সাপোর্ট টিম হাজীকে উদ্ধার/সহায়তা করবেন। এই অ্যাপ থেকে জানা যাবে নামাজের সময়সূচি, প্রতিদিনের করণীয়, দৈনিক হজ শিডিউল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আবাসন তথ্য যেমন হোটেলের নাম, ঠিকানা, দূরত্ব, ছবি, ভিডিও, চেক-ইন/চেক-আউট তারিখ ইত্যাদি। হজযাত্রী ফ্লাইটের বিস্তারিত তথ্য যেমন ফ্লাইট কোড, বোর্ডিং টাইম, ডিপারচার ও অ্যারাইভাল টাইম, লাগেজের ওজনসীমা ইত্যাদি মিলবে এই অ্যাপ থেকে। লোকেশন ট্রাকিং যেমন হজযাত্রী গুগল ম্যাপে নিজেদের বা দলের অন্যান্য সদস্যদের অবস্থান নির্ণয়, পরিবারের সদস্য কর্তৃক তাদের হজযাত্রী ট্রাকিং, মিনা-আরাফার তাঁবুর লোকেশন ট্রাকিং সেবাও রয়েছে এই অ্যাপে। এছাড়া রয়েছে হজ প্রি-পেইড কার্ডের ব্যালান্স, ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্রোফাইল তথ্য ও সার্বক্ষণিক ভার্চুয়াল স্বাস্থ্য সহায়তা, বাংলাদেশ মেডিক্যাল সেন্টার ও সৌদি হাসপাতালের তথ্য, গাইডভিত্তিক গ্রুপ যোগাযোগ সুবিধা, কুরআন ও হাদিস লাইব্রেরি, কিবলা নির্দেশনা, ডিজিটাল তাসবিহ, হজ ও উমরাহ সহায়িকা, কোরবানি কুপন সংগ্রহ কেন্দ্রের তালিকা ও মক্কা ও মদিনার ঐতিহাসিক স্থানের বিবরণ, হজ এজেন্সির তথ্য যেমন এজেন্সি নাম, লাইসেন্স নম্বর, প্যাকেজ, রেটিং, রিভিউ প্রদান ইত্যাদি সেবা।
এবছর হজযাত্রা নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে চালু করা হয়েছে হজ প্রি পেইড কার্ড। সরকারের নির্দেশনার আলোকে এই কার্ড চালু করেছে ইসলামী ব্যাংক পিএলসি। এই কার্ড নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি লাঘব করেছে। এই কার্ড ইস্যুতে অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন নেই। এটি ক্যাশের পরিপূরক এবং কার্ডের মেয়াদ ০৫ বছর। ইসলামী ব্যাংকের সকল শাখা থেকে এ কার্ড পাওয়া যাবে। হজ প্রিপেইড কার্ডের অনেকগুলো সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। সুবিধাসমূহের মধ্যে রয়েছে তৎক্ষণাৎ কার্ড ইস্যু ও ডেলিভারি, কার্ড ইস্যুতে কোন চার্জ/ফি নেই, ট্রানজেকশন প্রসেস ফি ৩ শতাংশ এর স্থলে ১ শতাংশ, হজ পরবর্তী সময়েও এ কার্ড ব্যবহার করা যাবে, বাংলাদেশি টাকা লোড করে ডলার/সৌদি রিয়াল পাওয়া যাবে, প্রত্যেক হজযাত্রী ১২০০ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ প্রায় ১,৫০,০০০ টাকা কার্ডে লোড করে নিতে পারবেন, সৌদি আরবে মাস্টার কার্ড লোগোযুক্ত এটিএম বুথ থেকে নগদ সৌদি রিয়াল উত্তোলন, পিওএস মেশিনে পেমেন্ট সুবিধা, কার্ডে ব্যালেন্স রিলোড এবং (১০)অব্যবহৃত ব্যালেন্স রিফান্ড সুবিধা।
এই কার্ড ইস্যু ও ডলার এনডোর্সমেন্টের জন্য প্রয়োজন হবে মূল পাসপোর্ট/ পাসপোর্টের ফটোকপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, দুই কপি ছবি, হজ ভিসার কপি ও সচল মোবাইল নম্বর। এই কার্ডের বিষয়ে দেশ থেকে কল সেন্টারে ১৬২৫৯ এবং ০২-৮৩৩১০৯০ নম্বরে ফোন করে কিংবা ইসলামী ব্যাংকের যে কোনো শাখায় যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাবে। আর বিদেশ থেকে +৮৮০১৮৪৪২৪২৬৪৬ ও +৮৮০১৮১৩১৯৭৯১৫ হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে অথবা কল সেন্টারে +৮৮০৯৬১১০১৬২৫৯ নম্বরে ফোন করে তথ্য পাওয়া যাবে।
২০২৫ সালের হজে হজযাত্রীদের জন্য দেশের অন্যতম মোবাইল ফোন সার্ভিস কোম্পানি ‘গ্রামীণফোন’, ‘বাংলালিংক’ ও ‘রবি’ বিশেষ ফোন রোমিং প্যাকেজ চালু করেছে। রোমিং প্যাকেজের সুবিধাসমূহের মধ্যে আছে: হাজিগণ সৌদি আরবে মোবাইল সিম ক্রয় ছাড়াই বাংলাদেশে ব্যবহৃত নিজস্ব মোবাইল সিমের মাধ্যমে প্রিয়জনদের সাথে কথা বলতে ও বার্তা পাঠাতে পারবেন। হজ রোমিং প্যাকেজসমূহ সৌদি মোবাইল অপারেটরসমূহের রেটের তুলনায় সাশ্রয়ী। হাজিগণ প্রচলিত পেমেন্ট গেটওয়ে অথবা অপারেটরদের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে দেশীয় মুদ্রায় সহজেই ১-৬০ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের প্যাকেজ ক্রয় ও অ্যাক্টিভেট করতে পারবেন। গ্রামীণফোন ও রবির প্যাকেজসমূহ ক্রয়ের দিন হতেই সক্রিয় হবে। তবে বাংলালিংকের প্যাকেজসমূহ হাজিগণ সৌদি আরব পৌঁছামাত্র সক্রিয় হবে। বাংলালিংকের পোস্টপেইড গ্রাহকরা রোমিং ভয়েস কল সুবিধা পাবেন না। প্যাকেজ মূল্যের চেয়ে কম অথবা বেশি টাকা রিচার্জ করলে প্যাকেজ অ্যাক্টিভেট হবে না।
হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান। তাদের হজযাত্রাকে মসৃণ করতে সরকার সদা তৎপর। এবছর মোবাইল অ্যাপ, হজ প্রিপেইড কার্ড ও মোবাইল ফোন রোমিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে হজ ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সরকারের এসকল পদক্ষেপের মাধ্যমে হজ পালন হবে সহজ, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী।
#
লেখক: মোঃ আবুবকর সিদ্দীক,জনসংযোগ কর্মকর্তা, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়
পিআইডি ফিচার